Wednesday, August 13, 2008

পূজা পরিক্রমা:




ছবি সংযোজনা ~
সুপর্ণা মিত্র (প্যারিস, ফ্রান্স)

গীতি আলেখ্য :

Get this widget Track details eSnips Social DNA

পৃথিবীর আলাদা আলাদা প্রান্ত থেকে আলাদা ভাবে রেকর্ড করে এই অডিও লিঙ্ক গুলো পাঠিয়েছেন বাংলার বধূরা। মজার কথা হল - এরা কেউ কারোকে চেনেন না, কেউ কারোকে দেখেন নি। তবু এক আশ্চর্য আনন্দগ্রন্থিতে বাঁধা এঁরা।

৫০ মিনিটের এই গীতি-আলেখ্যে যারা যোগদান করেছেন তাঁদের পরিচিতি :

মঙ্গলশঙ্খ বাজিয়েছেন শুচিস্মিতা বন্দোপাধ্যায় (ফিজি)

সঙ্গীতে ~
আনন্দধারা বহিছে ভুবনে : সুজাতা চক্রবর্তী(সেন্ট লুই, আমেরিকা থেকে)
আলোকের এই ঝর্নাধারায় : শ্রদ্ধা পত্রনবীশ (ওরেগন, আমেরিকা থেকে)
শরত আলোর কমল বনে : শুচিস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায় (ফিজি থেকে)
এক এক্কে এক : তনুশ্রী নন্দী (সেন্ট লুই, আমেরিকা থেকে)
বাজলো তোমার আলোর বেণু : পার্বতী বোস (বস্টন, আমেরিকা থেকে)
জাগো, তুমি জাগো : গৌরী চক্রবর্তী (আমেরিকা থেকে)
জয় জয় হে মহিষাসুর-মর্দিনী : শর্মিলা দাশগুপ্ত ও শ্রেয়া দাশগুপ্ত (দিল্লী, ভারত থেকে)
প্রথম আদি তব শক্তি : সুদীপ্তা সামন্ত (শেফিল্ড, ইউ কে থেকে)
অমল ধবল পালে : সুকন্যা দে (কেমব্রিজশায়র, ইউ কে থেকে)
আমার রাত পোহালো : শ্রদ্ধা পত্রনবীশ (ওরেগন, আমেরিকা থেকে)

আবৃত্তি ~
পুজোর সাজ : গৌরী চক্রবর্তী (আমেরিকা থেকে)
আনন্দময়ীর আগমনে : অমৃতা নন্দী (সেন্ট লুই, আমেরিকা থেকে)
শরৎ : বিদুলা ব্যানার্জী (কলকাতা, ভারত থেকে)

ভাষ্যপাঠ ~
বিদুলা ব্যানার্জী (কলকাতা, ভারত থেকে)

গ্রন্থনা ~
শুচিস্মিতা সরকার (সেন্ট লুই, আমেরিকা থেকে)

অডিও সংযোজনা ~
সুপর্ণা মিত্র (প্যারিস, ইউরোপ থেকে)

বিশেষ কৃতজ্ঞতা ~
শ্রী রজতশুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
শ্রী চন্দ্রশেখর ভট্টাচার্য্য

Sunday, August 10, 2008

Greeting the Mother - Akaal Bodhan :


This coming weekend we will celebrate Durga Puja. This her Akaal Bodhon, her Untimely Manifestation. Her real puja is the Basanti Puja. However faced with possible defeat in his battle to reclaim his beautiful wife Sita, in an eons later epic battle of the Ramayana, Prince Rama invokes the primal Shakti in the form of Durga-the warrior Godess. She has been created to vanquish the almost invincible Mahisha, a king of the dark world.Mahisha spent years praying for the boon of immortality, but eventually settled for a lesser boon that would allow him to die only at the hand of a woman. Satisfied that it was an impossible event, Mahisha being an extraordinary warrior, began to tyrannize all the three worlds.Thus there was the creation of Devi, in the form of a woman. The metaphor being that all are born of a mother, without whom life is not possible. Thus the giver of Life is the the strongest force known. However Mahisha in his arrogance paid no attention to this, and scoffed at this beautiful woman who came riding on a roaring lion to fight him. He did not notice that she was symbolically gifted every weapon known, including the ones symbolizing peace and mercy-the necessary qualities of the greatest warriors. Over eight terrifying days the Demon fought the Mother, shattering the three worlds, and was slain on the eighth (Mahashtami- the Great Eighth). Mahisha died at Her feet, but not before asking for Her forgiveness as an errant son would ask of his mother. Of course like every mother, Durga tenderly forgave Her son. Tradiditionally, this event was commemorated in Ma Durga's puja held in the spring time, and called Basanti Puja.
But then how did we start celebrating Durga Puja in Autumn (Shorot kaal).
Well, The Mother came to us in the season in her Akaal Bodhon- Untimely Manifestation- because of another great story of triumph of Good over Evil.

In the time of Sri Rama, the heroic Prince and King elect of Ayodhya, The rich and powerful King Ravana of Lanka Dwip succumbed to lust and abducted Sita, Rama's exquisitely beautiful wife Sita. Rama, Sita and Rama's younger brother Lakhsmana are serving an exile in the forest due to a debt of honour that Rama must pay to his dying father and his stepmother Kaikeyi. The brothers are hopelessly outdone in terms of armies and weapons against such an invincible foe; all they have is the power and courage of the Right Path. Rama invokes the power of Durga, to fight the mighty King Ravana, who has abducted Sita. His brother Lakshmana is mortally wounded and his allies are monkeys, and vultures. Rama is desperate. His puja must be completed before dawn, when he will attack. It is the eighth day of prayer, just like the eighth day of battle between Durga and Mahisha. His Sandhi Puja needs one hundred and eight blue lotuses, the rarest and the best, but he has only one hundred and seven lotuses. So he determines to sacrifice one of his eyes, as the hundred and eighth. Durga is touched. She blesses him. He goes on to victory.
So we celebrate Rama's puja today and pray to Ma Durga as She appeared to Rama in an untimely and desperate situation. After all, we feel we need the Mother's intervention at all those times when we are desperate. Wishing all readers of this account that they be blessed by their mothers, who are the representatives of the Divine Mother, on this earth.

Ya Devi Sarvabhuteshu Matri Rupena Samstitha,
Namastasyai Namastasyai Namastasyai Namoh Namaha !

(O Devi , All pervasive, Who appears in the form of Mother,
we bow worshipfully , we bow worshipfully, we bow worshipfully)

Photograph courtesy : Internet





Devlina Sen
San Diego, USA
12th August, 2008

Saturday, August 2, 2008

ফিজির মাটিতে প্রথম শারদীয়া দুর্গোৎসব…

আমার অরকুট এর এক প্রবাসের বান্ধবী যখন জানিয়েছিলেন যে তিনি কোনো এক পত্রিকায় লেখা পড়েছিলেন "ফিজিতে দুর্গাপ্রতিমা (ছবি সহ) রওনা দিলো”। আমি তৎক্ষণাৎ তার কথা ধূলিসাৎ করে বলি চোখের পাওয়ারটা ঠিক করো ওটা নিশ্চয় ফুজি হবে ফিজি না । আর তার ঠিক পাঁচ সপ্তাহ পরেই হঠাৎই একদিন স্বামীজীর ফোন সৌমেনকে “সন্ধ্যায় চলে আসুন কথা আছে” । আশ্রমে গিয়ে চমকিত হলাম মা দুর্গাকে দর্শন করে । এক চালচিত্রের ভিতরে মা তার চার পুত্র কন্যাকে সঙ্গে নিয়ে বাপের বাড়ী এসেছেন । ওই আশ্রমে তখন বেশ কিছু গুজরাটি পরিবারকে নিয়ে স্বামীজী নবরাত্রির ব্যাপারে আলোচনা করছিলেন । সেইখানেই তিনি সৌমেনকে পুজোর ভার দিলেন । সৌমেন যত না খুশি তার থেকে বেশী নার্ভাস যে স্বামীজীর উপস্হিতিতে তাকে পুজো করতে হবে । আমাদের ওপরেরই ভার দিলেন ওখানে যত বাঙালী ও অবাঙালী আছে তাদের বলার জন্য । উনি নিজে ভারতের হাই কমিশনার শ্রীযুক্ত ঝাঁ কে নিমন্ত্রন করার ভার নিলেন। আর মায়ের ভোগের ব্যাপার আমাদের ওপরেই ছেড়ে দিলেন । তবে ওনার একটি ইচ্ছা জানালেন যে খিচূড়ির সাথে লম্বা লম্বা বেগুন ভাজা থাকবে । আমরা লাউটোকাতে দুটি বাঙালী পরিবার…আমরা আর সঞ্জয় ,বেবী ও তাদের ৭ বছরের পুত্র অনুভব। আমরা দুই পরিবার সকলকে নিমন্ত্রন করার, বাজার করার ভার নিলাম। সুভাতে যদিও বেশ কিছু বাংলাদেশের হিন্দু পরিবার আছেন কিন্তু তাদের নিজেদের অনুষ্ঠান থাকে।তাই তারা লাউটোকা আসার ব্যাপারে তাদের অক্ষমতা জানালেন। তাদের কাছে পুজোর চেয়ে বেশী আনন্দ তাদের নিজেদের ঘরোয়া অনুষ্ঠান। সুভা থেকে ৪টি পরিবার, বা থেকে ২টি পরিবার, নান্দী থেকে ১টি পরিবার ও রামকৃষ্ণ মিশনের স্বামীজী এসেছিলেন। একটা কথা বলে নিই এই পুজোতে আমাদের সাথে লাউটোকার অন্য ভারতীয়রা এত সাহায্য করেছিল যে বলে শেষ করা যাবে না।

শুরু হয়েছিল অমাবস্যার একদিন পর থেকেই । আমাদের দুর্গা পুজো স্থির হলো নবমীর সন্ধ্যায়,শনিবার। আমরা দুই বাঙালী পরিবার রোজই সন্ধ্যাবেলা একবার করে মাকে দর্শনের লোভে আশ্রমে যেতাম। সেখানে আরতি হতো, পরে গরবা ও ডান্ডিয়া নাচ।গুজরাটিরা অম্বা মায়ের পুজো করতেন, অম্বা মা দূর্গার ই আর এক রূপ। মা দুর্গার প্রতিমার নীচেই অম্বা মাকে রাখা হয়েছিল। ওইখানেই আমি ও বেবী রোজ আলোচনা করেছি কী মেনু কতটা পরিমানে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। সকলের সহযোগিতা ও উৎসাহে মায়ের ভোগ রান্না করা হলো। মেনু হলো লুচি, আলুর দম, খিচূড়ি, বেগুন ভাজা, লাবরা, চাটনী, পায়েস, গুলাব জামন, আর নারকেল নাড়ু আমরা সকলে নিজেদের মধ্যে রান্নার দায়িত্ব ভাগ করে নিলাম ।প্রথমে বড় বড় হাড়ি, কড়াই, খুন্তি দেখে একটু নার্ভাস লাগছিল কিন্তু সকলের উৎসাহের কাছে তা কিছুই না।শুধু আমরা বাঙালীরাই না একই উদ্দম নিয়ে অবাঙালীরাও সমস্ত কাজে উৎসাহে সমানভাবে অংশগ্রহন করেছিল। মোটামুটি ৮০-৮৫ জনের রান্না করা হলো। সন্ধ্যা ৬ টায় পুজো শুরু হওয়ার কথা তাই বিকাল ৫ টার মধ্যেই আমরা সমস্ত রান্না করে ফেললাম। বাড়ী এসে তৈরী হয়ে আবার যখন আশ্রমে পৌঁছলাম তখন মাইকে ভেসে আসছিল সৌমেনের মন্ত্রাচারণের শব্দ। আশ্রমে পৌঁছে দেখি সেখানে উৎসাহী মানুষের ঢল নেমেছে। লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ায় এত ভীড়তবে এত ভীড় সত্ত্বেও কোনো কোলাহল নেই শুধু শোনা যাচ্ছে মন্ত্রাচারণের শব্দ। এরপর শুরু হল অঞ্জলি,ও তারপরে হলো আরতি।এরপরে স্বামীজী দুর্গা পুজো সন্মন্ধে কিছু বললেন, কে কীভাবে প্রথম দুর্গা পুজো শুরু করেন। খুব কম সময়ের জন্য কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা সম্ভব হয়নি। শুধু বাচ্চারা বন্দেমাতারম গাইল। অল্প সময়ের জন্য শ্রীযুক্ত ঝাঁ মশাই এসেছিলেন ।এরপর ভোগের ব্যবস্থা করা হল৮০ জনের জায়গায় প্রায় ১১৫ জন মতো হয়ে গেল, সমস্ত কিছুই বেশ ভালোভাবে শেষ হলো।

দশমীর দিন অবাঙালীদেরও দশেরা। ওইদিন গুজরাটিরা ছোটছোট মেয়েদের পা ধুইয়ে মুছে পুজো করে বস্ত্র ও খাদ্য দান করে প্রণাম করল। এরপর আরতি হলো। শ্রীযুক্ত ঝাঁ মশাই কিছু বক্তব্য রাখলেন ।এরপর নমস্কার ও কোলাকুলির পালা ও সব শেষে ছিল মহাপ্রসাদমহাপ্রসাদের আয়োজন গুজরাটি মহিলারাই করেছিলেন । দুপুরের খাওয়া শেষ হতে জ্যোতি ঘোষণা করলেন আজ রাত্রিতে তার বাড়ীতে খাওয়া স্বামীজীকে নিয়েসন্ধ্যায় আবার আরতি হলো। আমাদের ইচ্ছা ছিল সিন্দুর খেলার কিন্তু স্বামীজী তার অনুমতি দিলেন না । এরপর মা ও তার চার পুত্র কন্যাকে বাক্সবন্দী করা হলো আবার পরের বছরের প্রতীক্ষায়। তারপর আমরা সবাই বিজয়া সেরে যে যার গন্তব্যে ফিরে গেলাম। আমাদের এই পুজো সুন্দরভাবে হওয়ার পিছনে য়ার অবদান সবথেকে বেশী তিনি হলেন স্বামীজী, তিনি ছাড়া এটা করা সম্ভব ছিল না। ফিজির ইতিহাসে এটি একটি বিশাল দৃষ্টান্ত হয়ে রইল, এত আনন্দ বোধহয় দেশের মাটিতেও করিনি




লেখিকা : শুচিস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায়
১১ই জুলাই , ২০০৮
লাউটোকা(ফিজি)

সিঙ্গাপুরে দুর্গাপুজো:


সিঙ্গাপুর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটা ছোট্ট দেশ।চারিদিক সমুদ্র দিয়ে ঘেরা একটা দ্বীপ।এখানে বসবাসকারী মানুষের মধ্যে বেশীরভাগই চীনা,মালয় ও দক্ষিণ ভারতীয়।তবে বাঙালীর সংখ্যাও নেহাত কম না,আর যেখানে বাঙালী সেখানে দুর্গা পুজো হতেই হবে।

সিঙ্গাপুর এ মোট চারটি পুজো হয়ে থাকে।

১. খালশা বেঙ্গলী অ্যাসোসিয়েশন এর পুজো।

২. বাংলাদেশীরা ২টো পুজো করে থাকে।

৩. রামকৃষ্ণ মিশনের দুর্গা পুজো।

আমরা বাঙালীরা সাধারনত রামকৃষ্ণ মিশন ও খালশা অ্যাসোসিয়েশন এর দুর্গা পুজোতে সমবেত হয়ে থাকি। মা দুর্গার মূর্তি সূদুর কুমোরটুলি থেকে আনা হয়। যা পর পর ৩ বছর এখানেই থাকে। এখানকার বাঙালীরা যে পুজোর আয়োজন করেন,তা খুবই সুন্দর, বাঙালীয়ানায় ভরপুর। ষষ্ঠী’তে বোধন এর মাধ্যমে পুজো আরম্ভ হয়, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমীতে পুষ্পাঞ্জলি, অষ্টমী, নবমীর সন্ধ্যিক্ষণে সন্ধিপুজো, অষ্টমীতে কুমারি পুজো সবই আচার অনুষ্ঠান শ্রদ্ধা ও ভক্তির সাথে ৫ দিন ধরে পালন করা হয়।

আমরা যতক্ষন এখানে থাকি যেন ভুলে যায় যে আমরা নিজের দেশ ছেড়ে অন্য দেশে আছি। ঢাকের শব্দ আমাদের সব কিছু ভুলিয়ে দেয়। আমরা আনন্দে নেচে উঠি ঢাকের তালে তালে। প্রতিদিন সন্ধ্যেবেলা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এই ভাবে আমরা বাঙালীরা সিঙ্গাপুরের দুর্গাপুজোয় ৫ দিন প্রানভরা আনন্দে মেতে উঠি।









তৃষিতা ভট্টাচার্য্য গোস্বামী
সিঙ্গাপুর
২৮ শে জুলাই,২০০৮

প্রবাসে পুজো :


বিগত দু’বছর(২০০৬,২০০৭)আমার দুর্গা পুজো কেটেছে প্রবাসে মানে আমেরিকায়।
ছোটবেলা থেকেই বেশীর-ভাগ পুজোই কাটিয়েছি নিজের দেশে, নিজের শহরে, নিজের আত্মীয় স্বজন আর বন্ধুদের ভীড়ে। দুর্গা পুজোর দিন গুলোতে ভাই, বোন, কাকা, কাকীমা, জ্যেঠু, জ্যেঠিমা’রা সবাই একসাথে হতাম। এক একদিন এক এক জনের বাড়ীতে বসতো পুজোর আড্ডা। আর তার সাথে চলত তুমুল হই-হুল্লোর আর খাওয়া দাওয়া। সুতরাং বুঝতেই পারছ চিরকাল পুজো’তে এত হই-চই করে কাটিয়ে অবশেষে এসে পৌঁছালাম নতুন দেশে, নতুন সংস্কৃতির মাঝে, নতুন অচেনা মানুষের ভীড়ে তাও আবার দুর্গা পুজোর সময়। খুব মিস্ করতাম কলকাতার পুজো, পুজোর গন্ধ, পুজোর বাজার, পুজোয় ঢাকের বাদ্যি, পুজোর ভীড়, পুজোর সকালে মাটিতে ঝরে থাকা শিউলি ফুল.!

কিন্তু তাই বলে কি পুজোর দিন মন খারাপ করে বাড়ীতে বসে থাকব? পুজোর আনন্দ,পুজোর সাজ, হই হুল্লোর বাদ দেব? সে তো কিছুতেই হতে পারে না। তাই খোঁজ নিতে থাকলাম আসে-পাশের স্টেট-এ কোথায় কোথায় ভালো দুর্গা পুজো হয়। আমরা পেনসিলভানিয়ার শহর মরিসভিলে’তে থাকতাম তখন চেনা-জানা বাঙালী পরিবার বলতে কাছেই আমার এক কাজিন বোন ও তার স্বামী, এছাড়া আমাদের কমপ্লেক্স এ থাকত আরেক বাঙালী পরিবার। ঠিক করলাম এই ৩ পরিবার মিলেই কাটাবো পুজোর দিনগুলো। ইন্টারনেট খুঁজে বের করলাম নিউ-জার্সির গার্ডেন স্টেট পুজো কমিটির নাম। এদেশে আমাদের কলকাতার মতো ৫দিন ধরে পুজো হয় না, কোনো এক সপ্তাহান্তে শনি-রবিবার এ পুজো হয়। যাই হোক পুজোর দিন সকালে উঠে স্নান সেরে নতুন জামাকাপড় পরে রওনা দিলাম আমাদের গন্তব্য-স্থলের দিকে।

ওখানে পৌঁছে তো অবাক! এক স্কুল বাড়ীতে পুজো হচ্ছিল, সেখানে গিয়ে দেখলাম যেন বাঙালীর ঢল নেমেছে। সেখানে তাঁতের শাড়ী থেকে ফুচকা সবকিছুর স্টল বসেছে। সব মেয়েরা শাড়ী-গয়নায় সুসজ্জিত, বেশীরভাগ ছেলেরাই পাজামা-পাঞ্জাবি পরেছে। মাইকে ভাসছে ঠাকুর মশাই-এর পুজোর মন্ত্র। সম্পূর্ণ বাঙালী পরিবেশ ।
প্রথমদিন মানে শনিবার হল ষষ্ঠী-সপ্তমী আর অষ্টমীর পুজো আর তার পরের দিন মানে রবিবার হলো নবমী-দশমীর পুজো। ওই দুই দিন প্রতিমা দর্শন, অঞ্জলি দেওয়া, সকাল থেকে রাত অব্দি খাওয়া-দাওয়া,সিন্দুর খেলা, ধুনুচি নাচ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখা সবই হল। নচিকেতা,শিবাজী চট্ট্যোপাধ্যায় আর অরুন্ধুতি হোমচৌধুরীর সুন্দর সুন্দর বাংলা গান শুনে মনেই হল না পুজোতে কোলকাতার থেকে এত দূরে বসে আছি।

তাও যেন ঠিক মন ভরলো না। কোথায় যেন একটা শূন্যতা রয়ে গেল, যদি পুজোর কাজের সাথে যুক্ত হতে পারতাম তাহলে হয়তো আরও ভালো লাগতো, এই আফসোস একটা থেকে গেল।

২০০৭ এল। ঠিক করলাম এবার আরো বাঙালী বন্ধু জোগাড় করতে হবে। এর মধ্যে আমাদের কমপ্লেক্স’এর বাঙালী বন্ধুটি তার পরিবার নিয়ে ইন্ডিয়া ফিরে গেল। আমরা তখন দুটি বাঙালী পরিবার চেনা-জানা,৫-৬ মাস খোঁজার পর কয়েকটা বাঙালী পরিবারের খোঁজ পেলাম, এর-তার মুখ থেকে। ঠিক করলাম পয়লা বৈশাখ দেখা করব। কেউ কাউকে চিনি না, একবারও দেখা-কথা হয়নি। এর ওর মাধ্যমে যোগাযোগ করে শুধু নাম জানা।
একজন নন্ বেঙ্গলী বন্ধুর মাধ্যমেই সবার খোঁজ পাওয়া, আর তার হাত ধরেই আমরা দেখা করার দিন-স্থান ঠিক করলাম। ৫ জন বাঙালী পরিবার হয়ে গেলাম, মনেই হলো না প্রথম আলাপ। এত বন্ধুত্ব হয়ে গেল যে নিজেরা মিলেই সব বাঙালী অনুষ্ঠান করা শুরু করলাম।

এরপর এলো দুর্গা পুজোর সময়, সবাই মিলে ঠিক করলাম এবার নিজেরাই দুর্গা পুজো করলে কেমন হয়? সবারই বহুদিনের স্বপ্ন, ইচ্ছে—যেমন ভাবা তেমন কাজ। শুরু করে দিলাম পুজোর প্রস্তুতি। অবশেষে স্বপ্নটা’কে বাস্তব রূপ দিলাম। দুর্গা পুজো করলাম ৫ বাঙালী পরিবার মিলে, আমাদের মধ্যে একজনের বাড়ীতে। নিজেদের হাতে ঘর সাজানো, ফল কাটা, ফুলের মালা গাঁথা, ভোগ রাঁধা – এসবের আনন্দই আলাদা।

কোলকাতা থেকে এক বন্ধু সব নিয়ে এসেছিলো ছোট পোড়ামাটির দুর্গা প্রতিমার মুর্তি, পিতলের ঘট, কোসা-কুসি, আম্র-পল্লব, বেলপাতা, পুজোর সব উপকরণ। আগের দিন থেকে সবাই মিলে সারা বাড়ী আর পুজোর জায়গা ফুল, কাগজ দিয়ে কি সাজানোর ধুম!! ঢাকের আওয়াজ আর কাসর ঘন্টার ক্যাসেটও আনা হয়েছিলো, তাও বাজানো হল। খুব মজা করেছিলাম। ষষ্ঠী থেকে দশমী পুজো, অঞ্জলি দেওয়া, সন্ধ্যা আরতি, পুজো ভোগ, সিন্দুর খেলা, প্রতিমা বিসর্জন সব নিয়ম মেনে হয়েছিলো। কারণ আমাদের মধ্যেই একজন ছিলেন যিনি এর আগেও অনেকবার দুর্গা পুজো করেছিলেন। এই পুজোর আনন্দ অনুভুতির কথা কোনদিন ভুলব না। সারাজীবন মনের মণিকোঠায় উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।




অদিতি দত্ত রায়
নিউ জার্সি
৩০'শে জুলাই, ২০০৮

বিদেশে পুজো :



“আজ, মহাসপ্তমী, কলকাতার আকাশে অবশ্য এতক্ষণ মহাঅষ্টমীর সূর্য্য আর বাতাসে ঢাকের বাদ্যি। কোনোদিন দুপুরে আমি ঘুমাই না, কিন্তু আজ ঘুমিয়ে পড়েছিলাম নতুন শারদীয়া দেশ পড়তে পড়তে। কি স্বপ্ন দেখেছি আদৌ কিছু দেখেছি কিনা মনে নেই। কিন্তু হঠাৎ কিরকম একটা অনুভুতি হল-আমি যেন বাগবাজারে বড়ঘরের খাটে শুয়ে আছি। বিকেল হয়ে গেছে-নানু দাদু আমার পাশেই শুয়ে ছিলো, কোথায় যেন উঠে গেছে। আমি জানলা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবছি আমায় কেউ ডাকেনি, এরপর পুজো দেখতে বেড়োবো কখন???..........”।

দিনপঞ্জি : ১৮.১০.২০০৭
জারসে সিটি, নিউ জার্সি
আমেরিকা

হ্যাঁ গতবছর পুজোয় কলকাতা থেকে কয়েক লক্ষ মাইল দূরে থেকেও এইভাবে তার সঙ্গে ছিলাম আমি। পুজোর কলকাতা’কে ছেড়ে সেবার ই আমার প্রথম থাকা নয়, কিন্তু সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশে অনেক প্রিয়জনদের ছেড়ে শুধু একজন’কে অবলম্বন করে আর তার অবলম্বন হয়ে থাকা বটে।

সৌভাগ্যবশত নিউ জার্সি’তে প্রচুর বাঙালীর বাস, আর আমাদের বাড়ীর কাছাকাছি বেশ কিছু বন্ধুদের সূত্রে পুজোর প্রায় এক মাস আগে-ই আমরা কোথায় কোথায় পুজো হয়, কিভাবে প্রবেশাধিকার পেতে হবে তা নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করি।আগেও শুনেছিলাম যে আমেরিকাতে নির্দিষ্ট পুজোর দিনে পুজো হয় না, সপ্তাহান্তের দুই দিনে-ই পাঁচ দিনের শখ মেটাতে হয়। আগে কোনদিন ব্যাপারটা নিয়ে ভাবিই নি। কিন্তু সেবার শুনে খুব ভালো লাগলো, কিছু উৎসাহী লোক নিজেরাই দায়িত্ব নিয়ে এই ব্যবস্থা’টি তো করেছেন; আমাদের মতো প্রথম মায়ের কোল ছাড়া’দের পক্ষে সেটাই অনেক। আমরা নিউ জার্সি’র প্রিন্সটন বলে এক জায়গায় যাব ঠিক করলাম। আমি ও আমার কাছাকাছি থাকে এমন তিনজন বন্ধু কমলিকা, অর্চিতা ও কৃত্তিকা এক সঙ্গে গিয়ে হাজির হলাম শনিবার সকালে।

যাওয়ার আগে ৭’দিন পুরো প্ল্যানিং করতেই-ই লেগে গেল। কে, কি শাড়ী পড়ব, কিভাবে সাজব, বরদের সাজই বা কিরকম হবে? কলকতা’কে মিস্ করলেও ওখানেই একটি ছোট্ট কলকাতা তৈরী করে নিতে পারলাম আমরা। রাস্তায় যাওয়ার পথে একজন বিদেশী পুলিশ’কে ডেকে আমাদের ছবি তুলিয়ে তাকেও আমাদের আনন্দের শরিক করলাম কিছুটা। ঠিকানা অনুযায়ী পৌঁছে দেখলাম জায়গা’টি আসলে একটি স্কুল বাড়ী। একটা বিশাল হল আছে যেখানে মন্ডপ তৈরী করে মাতৃপ্রতিমা স্থাপিত হয়েছে, এছাড়া এক জায়গাতে আছে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা আর একটি জায়গায় চলছে প্রদর্শনী। ওপরে একটি অডিটোরিয়ামে বিকালে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের অয়োজনও করা হয়েছিলো। নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে মাতৃপ্রতিমা দর্শন ছাড়াও আমার আনন্দের আর একটি কারণ ছিলো; আমার স্কুল-এর এক বান্ধবী, যাকে আমি স্কুল ছাড়ার পাক্কা ১০ বছর পর আবার দেখতে পেলাম।

মাতৃপ্রতিমা ছিলো ঢাকের সাজের; কিন্তু এক চালার না। মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে চোখে জল এসে গেল। সত্যি কত ভাগ্য আমার এতদূরে এসেও মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছি, সাথে আছে সেই ঢাকের শব্দ, সেই ঘন্টাধ্বনি ও মন্ত্রাচারন। সেইদিনটা ছিল ২০শে অক্টোবর, ২০০৭। নবমী-সকালে আমরা দেবীর বোধন দেখলাম, মহাসপ্তমীর অঞ্জলি দিলাম। পুজো কমিটির একজন সদস্য বললেন “দেশে যখন কাশফুল ফোটা শুরু হয় আর আকাশে সাদা মেঘের নৌকা ভেসে যায় তখন যেমন মনে হয় পুজো আসছে, এখানেও আমরা যখন দেখি আকাশটা খুব সুন্দর সাদা ও নীল রঙে ভরে গেছে আর গাছ গুলো সেজে উঠেছে ‘ফল্ কালার’এ বুঝতে পারি মায়ের আসার সময় হয়ে এলো…..”। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য 'ফল্ কালার’ হল পাতা ঝরার সাজ, পাতা ঝরার আগে গাছ গুলো সব হলুদ, সবুজ, লাল, কমলা রঙে সেজে ওঠে; কি যে সুন্দর লাগে দেখতে, যা ভাষায় প্রকাশ করার ক্ষমতা নেই আমার। পুজোতে ঢাক’টা ছিলো বেশ নতুন রকম, অনেকটা কাসরের মতো আকৃতি, কিন্তু অনেকটা বড়ো আর একজন সদস্য’ই বাজাচ্ছিলেন সেটি আর পুজোর সব কাজ করছিলেন স্থানীয় সদস্যরা, তাই অনুষ্ঠানে ছিল খুব আন্তরিকতা।

পরেরদিন দশমী মানে রবিবারে আমরা দিলাম মহাঅষ্টমী ও মহানবমীর অঞ্জলি আর বিকালে হল সিন্দুর খেলা। আমার জীবনের প্রথম ‘সিন্দুর খেলা’ আমি খেললাম বাড়ী থেকে অনেক দূরে গড়ে ওঠা একটি পরিবারের অংশ হয়ে । সেদিন বিকালে সত্যি যেন বিজয়া দশমীর করুন সুর বাজছিলো কোথায়। মনে হচ্ছিল এই দু’দিন যাদের সাথে কাটালাম, আর কি কোনদিনও একসাথে কাটাবো পুজো! কে জানে পরেরবারের পুজোয় কে থাকব কতদূরে। সত্যি মানুষ কতকিছু ভেবে রাখে, কিন্তু হঠাৎ করে না ভেবে রেখে যা পাওয়া যায় তা অমুল্য। সবচেয়ে ভালো মুহুর্ত ছিলো যখন রবিবার বাড়ী ফেরার সময় দু’জন অচেনা মুখও পরস্পরকে বলে উঠছিলো ‘শুভ বিজয়া’। মনে হচ্ছিল এই তো আমরা পুরো বাঙালী আছি, আমাদের মাটি থেকে অনেক দূরে থেকেও আমরা নিজেদের মাটি তৈরী করে নিতে পেরেছি। কে বলে যে বাঙালী তার ভাষা ভুলে যাচ্ছে, তার সংস্কার ভুলে যাচ্ছে, অন্ততঃ একদিনের জন্যও তো কেউ কেউ ‘হ্যাপি বিজয়া’ না বলে ‘শুভ বিজয়া’ বলছে এটাও কিছু কম পাওয়া?

পুজো ছাড়াও উদ্যোক্তারা খুব সুন্দর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন, প্রথম দিন ছিল সদস্য’দের অভিনীত একটি নাটক আর তনুশ্রী শঙ্করের নাচের ট্রুপ-এর উপস্থাপনা আর মিস্ জোজোর গান। পরের দিন ছিল বাচ্চা’দের একটা নাচের অনুষ্ঠান, রুপঙ্করের গান।

বিদেশে আমার এই প্রথম পুজোর অভিজ্ঞতা আমার কাছে অবিস্মরণীয় অন্য যে কোনো প্রথম অভিজ্ঞতার মতো। সত্যি আন্তরিক’ভাবে ধন্যবাদ জানাই তাদের যারা এত সুন্দর একটি পরিবেশ তৈরী করে পুজোর আবহ উপহার দিয়েছিলেন আমাদের। উদ্যোক্তা’দের আরো সাফল্য কামনা করি। এবছর আমি অনেক দূরে আছি তাদের কাছ থেকে, ওই স্কুল বাড়ী, ওই প্রতিমা, ওই পরিবেশ –এই বছর আমায় হয়ত মনেই রাখবে না, কিন্তু আমি তাদের মনে রাখব। তাদের সবাই’কে মনে রেখে আমি যাব আমার অতি পরিচিত, অতি চেনা শৈশব, কৈশোরের পুজোর দিনগুলোতে, যারা হয়ত গতবছর আমায় অনেক খুঁজেছে……




পারমিতা দত্ত
ব্যাঙ্গালোর, কলকাতা
ইন্ডিয়া
২৪শে জুলাই, ২০০৮

যায় যদি দিন আমার………………. যাক না


গত বারো বছর ধরে দুর্গা-পুজোর সময় গুলো আমার এই প্রবাসে মানে ক্যালিফোর্ণয়ার বে অঞ্চলে কেটেছে।না না ভুল হল, আমি মাঝে একবার পুজো দেশে কাটিয়েছি। প্রথম দু তিন বছর খুব মানসিক কষ্টে কাটিয়েছি পুজোতে।প্রথমত এখানে দুর্গা পুজো উপলক্ষ্যে স্কুল, অফিস কিছু ছুটি থাকে না। দ্বিতীয়ত যখন পুজো হচ্ছে তখন এখানে হয় না, কারণ এখানে শনি-রবিবার ছাড়া সময় ও ছুটি হয় না লোকেদের। তৃতীয়ত, পুজোর সময় যখনই দেশে নিজের বাড়ীতে ফোন করেছি, সবার সহানুভুতি ঝরে পড়ত আমার জন্য, কিন্তু দাদা দিদিদের কারো পুজোর আনন্দ থেমে থাকত না আমার কথা ভেবে। আমি ভবতাম কি স্বার্থপর সবাই, পুজোতে আমাকে বাদ দিয়ে এরা খুব মজা করছে তো!! আস্তে আস্তে আমি বুঝতে শিখলাম স্বার্থপর আমি হয়ে গেছি, আমি আনন্দ করতে পারছি না বলে অন্যরা আনন্দ করছে দেখে হিংসা হচ্ছে। আমাকে তো কেউ বারন করেনি আনন্দ করতে!!

আমি যখন এই দেশে এসেছি তখন একটাই দুর্গা পুজো হত এই বে অঞ্চলে প্রায় ৪০ মাইল দূরে হেয়ার্ড(Hayward) বলে একটা জায়গাতে। একদিন-ই যেতাম কারণ বাচ্চাও তখন ছোট ছিলো। ওই সেদিন ই আমি ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী আর দশমীর প্রণাম সেরে আসতাম। তখনই জানতে পারলাম ওই দুর্গা প্রতিমার পুজো হচ্ছে গত পাঁচ বছর ধরে। কারণ ইন্ডিয়া থেকে প্রতিবছর প্রতিমা আনানোর খরচ অনেক।

তারপর মেয়েও একটু বড়ো হয়ে গেলো আর এরমধ্যে’ই জানতে পারলাম ওই পুজো কমিটির নিজেদের লোকজনদের মধ্যে ঝগড়া-ঝাটি হয়ে কিছু লোক মিলে একটা পুজো করবে – সেটা ছিলো ২০০১ সাল। আমি তো শুনেই আহ্লাদে আটখানা কারণ পুজো’টা হবে আমার বাড়ীর কাছে মানে মাত্র দশ মাইল দুরে, পালো অল্টো শহরে। নতুন পুজো, প্রচুর লোকজন দরকার কাজের জন্য, আমি ফোন করে উৎসাহ দেখালাম। পুজোর দিনে সকাল বিকাল- মানে শুক্রবার রাত থেকে রবিবার বিকাল পর্য্যন্ত টুকটাক কাজ করে দিলাম, রাত্রে ভালো আর্টিস্ট’দের গান শুনতাম মনে ভরে। এইখানে বলা খুব জরুরী যে আমি দেশে থাকতে কোনো কলকাতা বা বলিউড’এর আর্টিস্ট’কে সামনে থেকে দেখিনি বা কারোর গান শুনিনি, কিন্তু এই দেশে আমার প্রিয় সবাই’কে দেখা হয়ে গেছে মোটামুটি।

পুজোতে গিয়ে অনেক নতুন বন্ধু হয়ে গেল, দুপুরে খাবার( খিচুড়ি, তরকারি, চাটনী, মিষ্টি)পর সবাই মিলে গোল বসে আবার আড্ডা।কে কিরকম শাড়ী-জামা পড়েছে, পরনিন্দা-পরচর্চা তো আছেই, বাচ্চারাও ব্যস্ত সমবয়সীদের সাথে। সবার বর’রা আড্ডা দিচ্ছে নিজেদের মধ্যে। সবাই খুব রিল্যাক্স মুড এ। দেশে পাঁচদিনের পুজো এখানে দু’দিনে সারতে হবে তাই কেউ কেউ বিকালে চলে যেতো শাড়ী বদলাতে।সন্ধ্যে হলে তখন অন্যরকম অনুভুতি হতো আরতি দেখতে দেখতে। আমি হাত জোর করে মা দুর্গার কাছে মনে মনে অভিযোগ করতাম “দেশে সবাই তোমাকে পাঁচদিন দেখতে পাই, আর আমরা কি অপরাধ করেছি যে তুমি আমাদের কাছে মাত্র দু’দিন থাকো!” রবিবার বিকালে সবাই বিদায় জানাতে মিষ্টি সিন্দুর নিয়ে হাজির, কিন্তু প্রতিমার ওপর কোনো সিন্দুর দেওয়া যাবে না কারণ পরের বছর আবার ওই প্রতিমার পুজো হবে। নিজেরা একে ওপরকে সিন্দুর মাখানো, অনেকটা হোলি খেলার মতো হয়। সাথে ঢাকের তালে তালে নাচ-এক পলকের খুশির হওয়া স্মৃতি করে বাড়ী ফিরে এসে আবার পরেরদিনের জন্য স্কুল, অফিসের সব রেডি করে রেখে শুতে যায়।

মা দুর্গা আমার প্রতি বছরের ঘ্যানঘ্যানে অভিযোগ শুনে শুনে অবশেষে ঠিক করেছেন যে তিনি আমাদের কাছেও পাঁচ দিন থাকবেন। তোমরা অবাক হচ্ছো তাই না! কিন্তু সত্যি বলছি আমার কোনো কারসাজি নেই। আবার পুজো কমিটি’তে গন্ডগোল।২০০৪ এ একটা পুজো শুরু হয় আমার বাড়ীর একদম কাছে মানে ৮ মাইল দুরে সানিভেল শহরে। এখানে দেশের সময় অনুযায়ী বোধন থেকে মহাদশমী পর্য্যন্ত সব নিয়ম মেনে চলা হয় তা সেটা সপ্তাহের মধ্যেই হোক বা সপ্তাহান্তে। এখানেও কাজে লেগে গেলাম। পুজোর আগে প্যান্ডেলের ডেকোরেশন এর জন্য রাত জাগা আর তার ফাঁকে ফাঁকে আড্ডা- এক অসাধারন আনন্দ। আমরা বন্ধুরা বাচ্চাদের স্কুল এ ছেড়ে খুব সেজেগুজে চলে যায় পুজো মন্ডপ এ।শুধু গল্প করি না, কাজও করি। আবার বাচ্চাদের স্কুল ছুটির সময় হলে চলে আসি বাড়ী। ছোট বাচ্চারাও নানারকম অনুষ্ঠান করে। এই ক’দিন বরকে অফিসে বার বার ফোন করি, তাড়াতাড়ি বাড়ী আসার জন্য, না হলে সন্ধ্যা আরতি মিস্ হয়ে যাবে, শুধু কি আরতি!!কত কিছু খাবার- ফুচকা থেকে শুরু করে বিরিয়ানি সবকিছুর’ই স্টল বসে, কোনো কোনো স্টল এ লাইনে দাড়িয়ে সামনে পৌঁছানোর আগেই খাবার শেষ, আবার ছোট অন্য স্টল এ নানারকম দেশের জিনিসের পসরা নিয়ে বসে কতজন। কত চেনা জানার সাথে দেখা হয়। শুধু বাঙালী নয় অবাঙালীরাও অংশ নিতে থাকে এখানে দুর্গা পুজোতে। গত দু’বছর ধরে দু একটি বাচ্চাও মা-বাবার হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে, তাদের নাম ধরে মাইকে ঘোষণা করা হয়, সব মিলিয়ে পুজো পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে এখানে। বিশ্বাস করো এখন পুজো মানেই আমার ও আমার পরিবারের কাছে সাজ সাজ রব, এক খুশির হাওয়া, বাড়ী সাজাই অনেক রঙের আলো দিয়ে। শুধু তাই নয়, অনেকদিন ধরে চলে বিজয়ার খাওয়া-দাওয়া। তারপর আসে দেয়ালি, আমরাও শব্দহীন বাজি ফাটাই সব বন্ধুরা মিলে। গত দু’বছর ধরে আমরা ভারতীয়রা এখানে বাচ্চাদের স্কুল এ গিয়ে দেয়ালি পালন করায়, সব দেশের বাবা-মা ও তাদের বাচ্চারা অংশ নেয়। আর তারপর ভাইফোঁটা। আমরা সবাই অপেক্ষা করে থাকি, ওইদিন সব নিয়ম মেনে ভাইফোঁটা হয়, আমার দুই মেয়ে তো এত খুশি হয় যে ভাইফোঁটার দুদিন পরেই বলে “ মা,চলো আমরা আবার ভাইফোঁটা করি, সবাই’কে ডাকো”।

আমরা বাংলার বাইরে থাকি কিন্তু মনেপ্রানে যে বাঙালী, আমাদের কাছে উৎসব মানেই সবার সাথে মিলে আনন্দ আর দেশের মাটির গন্ধ না পাওয়ার দুঃখ ভুলে থাকা। আমরাও সারা বছর অপেক্ষা করে থাকি এই কটা দিনের জন্য তা নয় এ একটা চ্যালেঞ্জও আমাদের কাছে এই বাঙালী ঐতিহ্য ধরে রাখা।আমরাও মনেপ্রানে চাই আমাদের ছেলে-মেয়েরা যেখানেই থাকুক না কেন এই ঐতিহ্য যেন ধরে রাখে গর্বের সাথে।




মৌসুমী হালদার
ক্যালিফোর্ণিয়া, আমেরিকা
৩০'শে জুলাই, ২০০৮

Friday, August 1, 2008

বাড়ির পুজোর অভিজ্ঞতা :


আমি কলকাতার মেয়ে, বাবা ঘোরতর নাস্তিক। বাড়ীতে পূজা অর্চনার কোন পাঠ ছিল না। আমার পড়াশুনার বেশীরভাগটাই কেটেছে খ্রীষ্টান স্কুল ও কলেজে। সব মিলিয়ে পূজা পার্বন বা তার নিয়মকানুনের ব্যাপারে আমি প্রায় অজ্ঞ। সেই আমার যখন বিয়ে ঠিক হল জানতে পারলাম যে আমার শ্বশুড়বাড়িতে দুর্গাপূজা হয়। শুনে খুব কৌতুহল হয়েছিল। এত কাছ থেকে দুর্গাপূজা দেখার এবং তাতে সক্রিয় অংশ নেওয়ার সুযোগ যে নিজের জীবনেই আসবে আগে কোনদিন ভাবিনি।

আমার শ্বশুড়বাড়ী চূঁচূড়া। গঙ্গার ধারে গড়ে ওঠা অতি প্রাচীন এক মফস্বল শহর। আমার শ্বশুড়মশাইরা এই শহরের পুরানো বাসিন্দা। পৈতৃক জমিতে সব ভাইয়েরা আলাদা আলাদা বাড়ি করে থাকেন। কিন্তু পূজাটা শরিকী। তাই দুর্গাপূজা উপলক্ষে বাড়ীর সবার মধ্যে সাময়িক একটা মেলবন্ধন হয়। নিজেদের জমির মধ্যেই ঠাকুর দালান আছে। সেখানে প্যাণ্ডেল করে পূজা হয়।

প্রচুর উৎসাহ আর উদ্দীপনা নিয়ে আমি বিয়ের পর প্রথমবার দুর্গাপূজা উপলক্ষে শ্বশুড়বাড়ী যাই ২০০৫ সালে। পঞ্চমীর দিন দুপুরে বাড়ী পৌঁছে প্রথমেই মণ্ডপে ঢুকলাম। দেখি আমার দেওর এবং ভাশুরপোরা সদলবলে মণ্ডপ সাজাতে ব্যস্ত। ঢাকিরাও চলে এসেছে। সবার মধ্যেই যেন শেষ মুহূর্তের ব্যস্ততা। পরেরদিন ষষ্ঠি। দেবীর বোধন। চক্ষুদানের মাধ্যমে মাটির প্রতিমায় প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এটাই দুর্গাপূজার শুরু।

সপ্তমীর দিন ভোরবেলা ঢাকের আওয়াজে ঘুম ভাঙ্গল। স্নান করে নতুন শাড়ী পরে খুড়শ্বশুড়মশাইয়ের বাড়ির বারান্দায় হাজির হলাম। দেখি অন্যান্য শাশুড়ী ও জায়েরা ইতিমধ্যেই উপস্থিত। সবাই মিলে ফল কাটা আর পূজার অন্যান্য আয়োজন সাজাতে ব্যস্ত। আমার অনভিজ্ঞতার কথা শ্বশুড়বাড়ীর সবাই জানতেন। কিন্তু ওদের উৎসাহে উৎসাহিত হয়ে আমি কাজে যোগ দিলাম। কিছুক্ষণ পর পূজা শুরু হল। সবাই তখন মণ্ডপে হাজির। প্রয়োজনে পুরোহিত মশাইকে জিনিষপত্র এগিয়ে দিচ্ছি, আবার নিজেদের মধ্যে হাল্কা হাসিঠাট্টাও চলছে। তার মধ্যেই যে যার ঘরের কাজ মেটাতে ছুটছে। পূজার শেষে আবার যার যার নিজের নিজের ঘরে ফিরে গিয়ে খাওয়া-দাওয়া করে কিছুক্ষণের বিশ্রাম। বিকাল থেকে আবার পরেরদিনের পূজার প্রস্তুতি। আর তার ফাঁকেই আশেপাশের বারোয়ারি ঠাকুর দেখতে যাওয়া।

দুর্গাপূজার সব থেকে বড় আর্কষণ অষ্টমী। ভোরবেলা থেকেই তার প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। সেদিন বাড়ীর সবাই উপোস করেন অঞ্জলী দেওয়ার জন্য। অঞ্জলীর পর পূরোহিত মশাই ধূনুচি নাচ সহযোগে দেবীর আরতি করেন। এইদিন সন্ধ্যার আকর্ষণ সন্ধিপূজা। আমাদের বাড়ীতে সন্ধিপূজার একটা বৈশিষ্ট্য আছে। মণ্ডপের ভেতর ঠাকুরের সামনে চারটে কলাগাছকে চারপাশে রেখে বাঁশ দিয়ে একটা কাঠামো তৈরী করা হয়। সেই বাঁশের উপর ১০৮ টা প্রদীপ সাজিয়ে জ্বালানো হয়। সারাদিনের কাজের পর সেদিন আর কারোর বাইরে যেতে ইচ্ছা করে না। মন্ডপেই আসর বসে। ছেলেরা ধূনুচি নাচ আর আরতি করে। তার ফাঁকে ফাঁকে আড্ডা চলে। মেয়েরা বসে মনের সুখে গল্প করে। তখন শাশুড়ী-ননদ-বৌ-ঠাকুর্মা/দিদিমা-নাতি/নাতনীরা সবাই মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়।

পরের দিন নবমী। এইদিনের পূজার বৈশিষ্ট্য হল যজ্ঞ। যজ্ঞের শেষে ঠাকুরকে বিশেষ ভোগ দেওয়া হয়। খিচুরী, নানারকম ভাজা, তরকারী, মাছ ইত্যাদি। তারপর আমরা সবাই একসঙ্গে ঠাকুরের ভোগ খেতে বসি। বাড়ীর ছাদে প্যাণ্ডেল করে ব্যবস্থা করা হয়। আত্মীয় এবং প্রতিবেশীদেরও নিমন্ত্রণ করা হয়। নবমীর সন্ধ্যা থেকেই মন খারাপের শুরু, যেন পূজা শেষের ঘণ্টাধ্বনি শুনতে পাই।

দশমীর দিন সকালে ঢাকের আওয়াজও করুণ লাগে। সবকিছুতেই যেন একটা বিদায়ের সুর। সকালবেলাই দর্পণ বিসর্জন হয়ে যায়। মানে দুর্গাপূজার শেষ। দুপুরবেলা বাড়ীর ছেলেরা সিদ্ধি তৈরী করে। বিকালবেলা প্রতিমা বিসর্জনের আগে বাড়ীর বৌয়েরা যায় দেবীবরণ করতে। ৫ জন এয়ো-স্ত্রী প্রথমে পুরো মণ্ডপটা ৭ বার প্রদক্ষিন করেন। প্রথম মহিলার হাতে থাকে গঙ্গাজলপূর্ণ ঘট। দ্বিতীয়জনের হাতে থাকে শাঁখ। বাকী ৩ জনের হাতে থাকে ধান, দুর্বা, সিঁদূর, ফল, মিষ্টি ইত্যাদি দিয়ে সাজানো থালা। এরপর মহিলারা একইভাবে দেবীকে ৭ বার প্রদক্ষিণ করেন এবং বরণ করেন। এই অনুষ্ঠানটাই আমার বরণডালা নেওয়ার ভার পড়েছিল। বরণপর্ব শেষ হলে শুরু হয় সিঁদূরখেলা। ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে সবাই সিঁদূরে মাখামাখি। প্রথমবার বলে আমার অবস্থা বেশ করুণ হয়েছিল। যাই হোক, বাড়ীর গুরুজনদের তাড়ায় যে যার মত পরিষ্কার হতে দৌড়লাম। ততক্ষণে ঠাকুর গাড়ীতে তোলা হয়ে গেছে। এরপর সবাই মিলে হেঁটে হেঁটে গাড়ীর পিছনে পিছনে গঙ্গার ঘাটে পৌছে গেলাম। বাড়ীর অল্পবয়সী ছেলেরা প্রতিমা নিয়ে গঙ্গায় নেমে গেল। আমরা পারে দাঁড়িয়ে দেবীপ্রতিমাকে গঙ্গায় তলিয়ে যেতে দেখলাম। দেখতে দেখতে মনে মনে বললাম আগামী বছর যেন আবার আসতে পারি। ফেরার পথে অবধারিত খাওয়া দাওয়া। ফুচকা, আলুকাবলি, এগরোল - যার যা মন চাইবে। নতুন বর হিসাবে সেবারের খাওয়ানোর দায়িত্বটা আমার বরের ওপর পড়েছিল। বাড়ী ফিরে সিদ্ধিপান। আমি খুব ভয়ে ভয়ে অল্প একটু খেয়েছিলাম। তারপর শুরু হল বিজয়ার প্রণাম।

পূজার দিনগুলোর অভিজ্ঞতা আমার কাছে অতুলনীয়। বিশেষ করে দুটো জিনিষ আমি অনুভব করেছি। প্রথমত, পূজার আচার বিধিগুলো পুরোপুরি আমাদের সামাজিক সংস্কার থেকে উঠে এসেছে। যেন সত্যিই আমাদেরই কোন ঘরের মেয়ে সপরিবারে বাপের বাড়ী বেরাতে এসেছে। তাই পুরো অনুষ্ঠানের মধ্যেই একটা আন্তরিকতার ছাপ দেখা যায়। আবার তার জন্যই হয়ত আচারবিধির মধ্যে আমাদের মনের "দাও দাও" ভাবটাও প্রবল। অনেক সময় মনে হয় যেন নিজেদের চাহিদাগুলো মেটানোই দেবী বন্দনার মূল কারণ। দ্বিতীয়ত, এ যেন এক মিলনমেলা। সবাই মিলে কাজ করে চলেছি, কিন্তু কারোর মনে কোন ক্ষোভ নেই, দেহে কোন ক্লান্তি নেই। মনে হয় আজকের ব্যস্ত আর বিচ্ছিন্ন জীবনের ফাঁকে এই আনন্দটা যেন আরো বেশী প্রয়োজনীয়।


শীলন সেনগুপ্ত চৌধুরী
৩১শে জুলাই, ২০০৮
কোলকাতা, ইন্ডিয়া