“আজ, মহাসপ্তমী, কলকাতার আকাশে অবশ্য এতক্ষণ মহাঅষ্টমীর সূর্য্য আর বাতাসে ঢাকের বাদ্যি। কোনোদিন দুপুরে আমি ঘুমাই না, কিন্তু আজ ঘুমিয়ে পড়েছিলাম নতুন শারদীয়া দেশ পড়তে পড়তে। কি স্বপ্ন দেখেছি আদৌ কিছু দেখেছি কিনা মনে নেই। কিন্তু হঠাৎ কিরকম একটা অনুভুতি হল-আমি যেন বাগবাজারে বড়ঘরের খাটে শুয়ে আছি। বিকেল হয়ে গেছে-নানু দাদু আমার পাশেই শুয়ে ছিলো, কোথায় যেন উঠে গেছে। আমি জানলা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবছি আমায় কেউ ডাকেনি, এরপর পুজো দেখতে বেড়োবো কখন???..........”।
দিনপঞ্জি : ১৮.১০.২০০৭
জারসে সিটি, নিউ জার্সি
আমেরিকা
হ্যাঁ গতবছর পুজোয় কলকাতা থেকে কয়েক লক্ষ মাইল দূরে থেকেও এইভাবে তার সঙ্গে ছিলাম আমি। পুজোর কলকাতা’কে ছেড়ে সেবার ই আমার প্রথম থাকা নয়, কিন্তু সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশে অনেক প্রিয়জনদের ছেড়ে শুধু একজন’কে অবলম্বন করে আর তার অবলম্বন হয়ে থাকা বটে।
সৌভাগ্যবশত নিউ জার্সি’তে প্রচুর বাঙালীর বাস, আর আমাদের বাড়ীর কাছাকাছি বেশ কিছু বন্ধুদের সূত্রে পুজোর প্রায় এক মাস আগে-ই আমরা কোথায় কোথায় পুজো হয়, কিভাবে প্রবেশাধিকার
যাওয়ার আগে ৭’দিন পুরো প্ল্যানিং করতেই-ই লেগে গেল। কে, কি শাড়ী পড়ব, কিভাবে সাজব, বরদের সাজই বা কিরকম হবে? কলকতা’কে মিস্ করলেও ওখানেই একটি ছোট্ট কলকাতা তৈরী করে নিতে পারলাম আমরা। রাস্তায় যাওয়ার পথে একজন বিদেশী পুলিশ’কে ডেকে আমাদের ছবি তুলিয়ে তাকেও আমাদের আনন্দের শরিক করলাম কিছুটা। ঠিকানা অনুযায়ী পৌঁছে দেখলাম জায়গা’টি আসলে একটি স্কুল বাড়ী। একটা বিশাল হল আছে যেখানে মন্ডপ তৈরী করে মাতৃপ্রতিমা স্থাপিত হয়েছে,
মাতৃপ্রতিমা ছিলো ঢাকের সাজের; কিন্তু এক চালার না। মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে চোখে জল এসে গেল। সত্যি কত ভাগ্য আমার এতদূরে এসেও মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছি, সাথে আছে সেই ঢাকের শব্দ, সেই ঘন্টাধ্বনি ও মন্ত্রাচারন। সেইদিনটা ছিল ২০শে অক্টোবর, ২০০৭। নবমী-সকালে আমরা দেবীর বোধন দেখলাম, মহাসপ্তমীর অঞ্জলি দিলাম। পুজো কমিটির একজন সদস্য বললেন “দেশে যখন কাশফুল ফোটা শুরু হয় আর আকাশে সাদা মেঘের নৌকা ভেসে যায় তখন যেমন মনে হয় পুজো আসছে, এখানেও আমরা যখন দেখি আকাশটা খুব সুন্দর সাদা ও নীল রঙে ভরে গেছে আর গাছ গুলো সেজে উঠেছে ‘ফল্ কালার’এ বুঝতে পারি মায়ের আসার সময় হয়ে এলো…..”। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য 'ফল্ কালার’ হল পাতা ঝরার সাজ, পাতা ঝরার আগে গাছ গুলো সব হলুদ, সবুজ, লাল, কমলা রঙে সেজে ওঠে; কি যে সুন্দর লাগে দেখতে, যা ভাষায় প্রকাশ করার ক্ষমতা নেই আমার। পুজোতে ঢাক’টা ছিলো বেশ নতুন রকম, অনেকটা কাসরের মতো আকৃতি, কিন্তু অনেকটা বড়ো আর একজন সদস্য’ই বাজাচ্ছিলেন সেটি আর পুজোর সব কাজ করছিলেন স্থানীয় সদস্যরা, তাই অনুষ্ঠানে ছিল খুব আন্তরিকতা।
পরেরদিন দশমী মানে রবিবারে আমরা দিলাম মহাঅষ্টমী ও মহানবমীর অঞ্জলি আর বিকালে হল সিন্দুর খেলা। আমার জীবনের প্রথম ‘সিন্দুর খেলা’ আমি খেললাম বাড়ী থেকে অনেক দূরে গড়ে ওঠা একটি পরিবারের অংশ হয়ে । সেদিন বিকালে সত্যি যেন বিজয়া দশমীর করুন সুর বাজছিলো কোথায়। মনে হচ্ছিল এই দু’দিন যাদের সাথে কাটালাম, আর কি কোনদিনও একসাথে কাটাবো পুজো! কে জানে পরেরবারের পুজোয় কে থাকব কতদূরে। সত্যি মানুষ কতকিছু ভেবে রাখে, কিন্তু হঠাৎ করে না ভেবে রেখে যা পাওয়া যায় তা অমুল্য। সবচেয়ে ভালো মুহুর্ত ছিলো যখন রবিবার বাড়ী ফেরার সময় দু’জন অচেনা মুখও পরস্পরকে বলে উঠছিলো ‘শুভ বিজয়া’। মনে হচ্ছিল এই তো আমরা পুরো বাঙালী আছি, আমাদের মাটি থেকে অনেক দূরে থেকেও আমরা নিজেদের মাটি তৈরী করে নিতে পেরেছি। কে বলে যে বাঙালী তার ভাষা ভুলে যাচ্ছে, তার সংস্কার ভুলে যাচ্ছে, অন্ততঃ একদিনের জন্যও তো কেউ কেউ ‘হ্যাপি বিজয়া’ না বলে ‘শুভ বিজয়া’ বলছে এটাও কিছু কম পাওয়া?
পুজো ছাড়াও উদ্যোক্তারা খুব সুন্দর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন,
বিদেশে আমার এই প্রথম পুজোর অভিজ্ঞতা আমার কাছে অবিস্মরণীয় অন্য যে কোনো প্রথম অভিজ্ঞতার মতো। সত্যি আন্তরিক’ভাবে ধন্যবাদ জানাই তাদের যারা এত সুন্দর একটি পরিবেশ তৈরী করে পুজোর আবহ উপহার দিয়েছিলেন আমাদের। উদ্যোক্তা’দের আরো সাফল্য কামনা করি। এবছর আমি অনেক দূরে আছি তাদের কাছ থেকে, ওই স্কুল বাড়ী, ওই প্রতিমা, ওই পরিবেশ –এই বছর আমায় হয়ত মনেই রাখবে না, কিন্তু আমি তাদের মনে রাখব। তাদের সবাই’কে মনে রেখে আমি যাব আমার অতি পরিচিত, অতি চেনা শৈশব, কৈশোরের পুজোর দিনগুলোতে, যারা হয়ত গতবছর আমায় অনেক খুঁজেছে……

পারমিতা দত্ত
ব্যাঙ্গালোর, কলকাতা
ইন্ডিয়া
২৪শে জুলাই, ২০০৮
1 comment:
Amerikar Pujor sharthok rup bornona, shange chhobigulo pathoker upri paona.
Post a Comment