
গত বারো বছর ধরে দুর্গা-পুজোর সময় গুলো আমার এই প্রবাসে মানে ক্যালিফোর্ণয়ার বে অঞ্চলে কেটেছে।না না ভুল হল, আমি মাঝে একবার পুজো দেশে কাটিয়েছি। প্রথম দু তিন বছর খুব মানসিক কষ্টে কাটিয়েছি পুজোতে।প্রথমত এখানে দুর্গা পুজো উপলক্ষ্যে স্কুল, অফিস কিছু ছুটি থাকে না। দ্বিতীয়ত যখন পুজো হচ্ছে তখন এখানে হয় না, কারণ এখানে শনি-রবিবার ছাড়া সময় ও ছুটি হয় না লোকেদের। তৃতীয়ত, পুজোর সময় যখনই দেশে নিজের বাড়ীতে ফোন করেছি, সবার সহানুভুতি ঝরে পড়ত আমার জন্য, কিন্তু দাদা দিদিদের কারো পুজোর আনন্দ থেমে থাকত না আমার কথা ভেবে। আমি ভবতাম কি স্বার্থপর সবাই, পুজোতে আমাকে বাদ দিয়ে এরা খুব মজা করছে তো!! আস্তে আস্তে আমি বুঝতে শিখলাম স্বার্থপর আমি হয়ে গেছি, আমি আনন্দ করতে পারছি না বলে অন্যরা আনন্দ করছে দেখে হিংসা হচ্ছে। আমাকে তো কেউ বারন করেনি আনন্দ করতে!!
আমি যখন এই দেশে এসেছি তখন একটাই দুর্গা পুজো হত এই বে অঞ্চলে প্রায় ৪০ মাইল দূরে হেয়ার্ড(Hayward) বলে একটা জায়গাতে। একদিন-ই যেতাম কারণ বাচ্চাও তখন ছোট ছিলো। ওই সেদিন ই আমি ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী আর দশমীর প্রণাম সেরে আসতাম। তখনই জানতে পারলাম ওই দুর্গা প্রতিমার পুজো হচ্ছে গত পাঁচ বছর ধরে। কারণ ইন্ডিয়া থেকে প্রতিবছর প্রতিমা আনানোর খরচ অনেক।

তারপর মেয়েও একটু বড়ো হয়ে গেলো আর এরমধ্যে’ই জানতে পারলাম ওই পুজো কমিটির নিজেদের লোকজনদের মধ্যে ঝগড়া-ঝাটি হয়ে কিছু লোক মিলে একটা পুজো করবে – সেটা ছিলো ২০০১ সাল। আমি তো শুনেই আহ্লাদে আটখানা কারণ পুজো’টা হবে আমার বাড়ীর কাছে মানে মাত্র দশ মাইল দুরে, পালো অল্টো শহরে। নতুন পুজো, প্রচুর লোকজন দরকার কাজের জন্য, আমি ফোন করে উৎসাহ দেখালাম। পুজোর দিনে সকাল বিকাল- মানে শুক্রবার রাত থেকে রবিবার বিকাল পর্য্যন্ত টুকটাক কাজ করে দিলাম, রাত্রে ভালো আর্টিস্ট’দের গান শুনতাম মনে ভরে। এইখানে বলা খুব জরুরী যে আমি দেশে থাকতে কোনো কলকাতা বা বলিউড’এর আর্টিস্ট’কে সামনে থেকে দেখিনি বা কারোর গান শুনিনি, কিন্তু এই দেশে আমার প্রিয় সবাই’কে দেখা হয়ে গেছে মোটামুটি।
পুজোতে গিয়ে অনেক নতুন বন্ধু হয়ে গেল, দুপুরে খাবার( খিচুড়ি, তরকারি, চাটনী, মিষ্টি)পর সবাই মিলে গোল বসে আবার আড্ডা।কে কিরকম শাড়ী-জামা পড়েছে, পরনিন্দা-পরচর্চা তো আছেই, বাচ্চারাও ব্যস্ত সমবয়সীদের সাথে। সবার বর’রা আড্ডা দিচ্ছে নিজেদের মধ্যে। সবাই খুব রিল্যাক্স মুড এ। দেশে পাঁচদিনের পুজো এখানে দু’দিনে সারতে হবে তাই কেউ কেউ বিকালে চলে যেতো শাড়ী বদলাতে।সন্ধ্যে হলে তখন অন্যরকম অনুভুতি হতো আরতি দেখতে দেখতে। আমি হাত জোর করে মা দুর্গার কাছে মনে মনে অভিযোগ

মা দুর্গা আমার প্রতি বছরের ঘ্যানঘ্যানে অভিযোগ শুনে শুনে অবশেষে ঠিক করেছেন যে তিনি আমাদের কাছেও পাঁচ দিন থাকবেন। তোমরা অবাক হচ্ছো তাই না! কিন্তু সত্যি বলছি আমার কোনো কারসাজি নেই। আবার পুজো কমিটি’তে গন্ডগোল।২০০৪ এ একটা পুজো শুরু হয় আমার বাড়ীর একদম কাছে মানে ৮ মাইল দুরে সানিভেল শহরে। এখানে দেশের সময় অনুযায়ী বোধন থেকে মহাদশমী পর্য্যন্ত সব নিয়ম মেনে চলা হয় তা সেটা সপ্তাহের মধ্যেই হোক বা সপ্তাহান্তে। এখানেও কাজে লেগে গেলাম। পুজোর আগে প্যান্ডেলের ডেকোরেশন এর জন্য রাত জাগা আর তার ফাঁকে ফাঁকে আড্ডা- এক অসাধারন আনন্দ। আমরা বন্ধুরা বাচ্চাদের স্কুল এ ছেড়ে খুব সেজেগুজে চলে যায় পুজো মন্ডপ এ।শুধু গল্প করি না, কাজও করি। আবার বাচ্চাদের স্কুল ছুটির সময় হলে চলে আসি বাড়ী। ছোট বাচ্চারাও নানারকম অনুষ্ঠান করে। এই ক’দিন বরকে অফিসে বার বার ফোন করি, তাড়াতাড়ি বাড়ী আসার জন্য, না হলে সন্ধ্যা আরতি মিস্ হয়ে যাবে, শুধু কি আরতি!!কত কিছু খাবার- ফুচকা থেকে শুরু করে বিরিয়ানি সবকিছুর’ই স্টল বসে, কোনো কোনো স্টল এ লাইনে দাড়িয়ে

আমরা বাংলার বাইরে থাকি কিন্তু মনেপ্রানে যে বাঙালী, আমাদের কাছে উৎসব মানেই সবার সাথে মিলে আনন্দ আর দেশের মাটির গন্ধ না পাওয়ার দুঃখ ভুলে থাকা। আমরাও সারা বছর অপেক্ষা করে থাকি এই কটা দিনের জন্য তা নয় এ একটা চ্যালেঞ্জও আমাদের কাছে এই বাঙালী ঐতিহ্য ধরে রাখা।আমরাও মনেপ্রানে চাই আমাদের ছেলে-মেয়েরা যেখানেই থাকুক না কেন এই ঐতিহ্য যেন ধরে রাখে গর্বের সাথে।

মৌসুমী হালদার
ক্যালিফোর্ণিয়া, আমেরিকা
৩০'শে জুলাই, ২০০৮
2 comments:
khub bhalo laglo tomar pujor barnona. tomar anubutir sange nijekeo miliye nilam.
Moner katha likhechho... Ar besh kichhu information-o peye gelam.
shraddha.
Post a Comment