Saturday, August 2, 2008

প্রবাসে পুজো :


বিগত দু’বছর(২০০৬,২০০৭)আমার দুর্গা পুজো কেটেছে প্রবাসে মানে আমেরিকায়।
ছোটবেলা থেকেই বেশীর-ভাগ পুজোই কাটিয়েছি নিজের দেশে, নিজের শহরে, নিজের আত্মীয় স্বজন আর বন্ধুদের ভীড়ে। দুর্গা পুজোর দিন গুলোতে ভাই, বোন, কাকা, কাকীমা, জ্যেঠু, জ্যেঠিমা’রা সবাই একসাথে হতাম। এক একদিন এক এক জনের বাড়ীতে বসতো পুজোর আড্ডা। আর তার সাথে চলত তুমুল হই-হুল্লোর আর খাওয়া দাওয়া। সুতরাং বুঝতেই পারছ চিরকাল পুজো’তে এত হই-চই করে কাটিয়ে অবশেষে এসে পৌঁছালাম নতুন দেশে, নতুন সংস্কৃতির মাঝে, নতুন অচেনা মানুষের ভীড়ে তাও আবার দুর্গা পুজোর সময়। খুব মিস্ করতাম কলকাতার পুজো, পুজোর গন্ধ, পুজোর বাজার, পুজোয় ঢাকের বাদ্যি, পুজোর ভীড়, পুজোর সকালে মাটিতে ঝরে থাকা শিউলি ফুল.!

কিন্তু তাই বলে কি পুজোর দিন মন খারাপ করে বাড়ীতে বসে থাকব? পুজোর আনন্দ,পুজোর সাজ, হই হুল্লোর বাদ দেব? সে তো কিছুতেই হতে পারে না। তাই খোঁজ নিতে থাকলাম আসে-পাশের স্টেট-এ কোথায় কোথায় ভালো দুর্গা পুজো হয়। আমরা পেনসিলভানিয়ার শহর মরিসভিলে’তে থাকতাম তখন চেনা-জানা বাঙালী পরিবার বলতে কাছেই আমার এক কাজিন বোন ও তার স্বামী, এছাড়া আমাদের কমপ্লেক্স এ থাকত আরেক বাঙালী পরিবার। ঠিক করলাম এই ৩ পরিবার মিলেই কাটাবো পুজোর দিনগুলো। ইন্টারনেট খুঁজে বের করলাম নিউ-জার্সির গার্ডেন স্টেট পুজো কমিটির নাম। এদেশে আমাদের কলকাতার মতো ৫দিন ধরে পুজো হয় না, কোনো এক সপ্তাহান্তে শনি-রবিবার এ পুজো হয়। যাই হোক পুজোর দিন সকালে উঠে স্নান সেরে নতুন জামাকাপড় পরে রওনা দিলাম আমাদের গন্তব্য-স্থলের দিকে।

ওখানে পৌঁছে তো অবাক! এক স্কুল বাড়ীতে পুজো হচ্ছিল, সেখানে গিয়ে দেখলাম যেন বাঙালীর ঢল নেমেছে। সেখানে তাঁতের শাড়ী থেকে ফুচকা সবকিছুর স্টল বসেছে। সব মেয়েরা শাড়ী-গয়নায় সুসজ্জিত, বেশীরভাগ ছেলেরাই পাজামা-পাঞ্জাবি পরেছে। মাইকে ভাসছে ঠাকুর মশাই-এর পুজোর মন্ত্র। সম্পূর্ণ বাঙালী পরিবেশ ।
প্রথমদিন মানে শনিবার হল ষষ্ঠী-সপ্তমী আর অষ্টমীর পুজো আর তার পরের দিন মানে রবিবার হলো নবমী-দশমীর পুজো। ওই দুই দিন প্রতিমা দর্শন, অঞ্জলি দেওয়া, সকাল থেকে রাত অব্দি খাওয়া-দাওয়া,সিন্দুর খেলা, ধুনুচি নাচ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখা সবই হল। নচিকেতা,শিবাজী চট্ট্যোপাধ্যায় আর অরুন্ধুতি হোমচৌধুরীর সুন্দর সুন্দর বাংলা গান শুনে মনেই হল না পুজোতে কোলকাতার থেকে এত দূরে বসে আছি।

তাও যেন ঠিক মন ভরলো না। কোথায় যেন একটা শূন্যতা রয়ে গেল, যদি পুজোর কাজের সাথে যুক্ত হতে পারতাম তাহলে হয়তো আরও ভালো লাগতো, এই আফসোস একটা থেকে গেল।

২০০৭ এল। ঠিক করলাম এবার আরো বাঙালী বন্ধু জোগাড় করতে হবে। এর মধ্যে আমাদের কমপ্লেক্স’এর বাঙালী বন্ধুটি তার পরিবার নিয়ে ইন্ডিয়া ফিরে গেল। আমরা তখন দুটি বাঙালী পরিবার চেনা-জানা,৫-৬ মাস খোঁজার পর কয়েকটা বাঙালী পরিবারের খোঁজ পেলাম, এর-তার মুখ থেকে। ঠিক করলাম পয়লা বৈশাখ দেখা করব। কেউ কাউকে চিনি না, একবারও দেখা-কথা হয়নি। এর ওর মাধ্যমে যোগাযোগ করে শুধু নাম জানা।
একজন নন্ বেঙ্গলী বন্ধুর মাধ্যমেই সবার খোঁজ পাওয়া, আর তার হাত ধরেই আমরা দেখা করার দিন-স্থান ঠিক করলাম। ৫ জন বাঙালী পরিবার হয়ে গেলাম, মনেই হলো না প্রথম আলাপ। এত বন্ধুত্ব হয়ে গেল যে নিজেরা মিলেই সব বাঙালী অনুষ্ঠান করা শুরু করলাম।

এরপর এলো দুর্গা পুজোর সময়, সবাই মিলে ঠিক করলাম এবার নিজেরাই দুর্গা পুজো করলে কেমন হয়? সবারই বহুদিনের স্বপ্ন, ইচ্ছে—যেমন ভাবা তেমন কাজ। শুরু করে দিলাম পুজোর প্রস্তুতি। অবশেষে স্বপ্নটা’কে বাস্তব রূপ দিলাম। দুর্গা পুজো করলাম ৫ বাঙালী পরিবার মিলে, আমাদের মধ্যে একজনের বাড়ীতে। নিজেদের হাতে ঘর সাজানো, ফল কাটা, ফুলের মালা গাঁথা, ভোগ রাঁধা – এসবের আনন্দই আলাদা।

কোলকাতা থেকে এক বন্ধু সব নিয়ে এসেছিলো ছোট পোড়ামাটির দুর্গা প্রতিমার মুর্তি, পিতলের ঘট, কোসা-কুসি, আম্র-পল্লব, বেলপাতা, পুজোর সব উপকরণ। আগের দিন থেকে সবাই মিলে সারা বাড়ী আর পুজোর জায়গা ফুল, কাগজ দিয়ে কি সাজানোর ধুম!! ঢাকের আওয়াজ আর কাসর ঘন্টার ক্যাসেটও আনা হয়েছিলো, তাও বাজানো হল। খুব মজা করেছিলাম। ষষ্ঠী থেকে দশমী পুজো, অঞ্জলি দেওয়া, সন্ধ্যা আরতি, পুজো ভোগ, সিন্দুর খেলা, প্রতিমা বিসর্জন সব নিয়ম মেনে হয়েছিলো। কারণ আমাদের মধ্যেই একজন ছিলেন যিনি এর আগেও অনেকবার দুর্গা পুজো করেছিলেন। এই পুজোর আনন্দ অনুভুতির কথা কোনদিন ভুলব না। সারাজীবন মনের মণিকোঠায় উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।




অদিতি দত্ত রায়
নিউ জার্সি
৩০'শে জুলাই, ২০০৮

1 comment:

শারদীয়া পুস্পাঞ্জলি said...

Bhishon bhalo legechhe Aditi Pujor bornona porte. Bideshe eshe erokom ekta ghoroya utshob korte parle taar je ananda , ta bujhte parchhi.

Shraddha.