Friday, August 1, 2008

বাড়ির পুজোর অভিজ্ঞতা :


আমি কলকাতার মেয়ে, বাবা ঘোরতর নাস্তিক। বাড়ীতে পূজা অর্চনার কোন পাঠ ছিল না। আমার পড়াশুনার বেশীরভাগটাই কেটেছে খ্রীষ্টান স্কুল ও কলেজে। সব মিলিয়ে পূজা পার্বন বা তার নিয়মকানুনের ব্যাপারে আমি প্রায় অজ্ঞ। সেই আমার যখন বিয়ে ঠিক হল জানতে পারলাম যে আমার শ্বশুড়বাড়িতে দুর্গাপূজা হয়। শুনে খুব কৌতুহল হয়েছিল। এত কাছ থেকে দুর্গাপূজা দেখার এবং তাতে সক্রিয় অংশ নেওয়ার সুযোগ যে নিজের জীবনেই আসবে আগে কোনদিন ভাবিনি।

আমার শ্বশুড়বাড়ী চূঁচূড়া। গঙ্গার ধারে গড়ে ওঠা অতি প্রাচীন এক মফস্বল শহর। আমার শ্বশুড়মশাইরা এই শহরের পুরানো বাসিন্দা। পৈতৃক জমিতে সব ভাইয়েরা আলাদা আলাদা বাড়ি করে থাকেন। কিন্তু পূজাটা শরিকী। তাই দুর্গাপূজা উপলক্ষে বাড়ীর সবার মধ্যে সাময়িক একটা মেলবন্ধন হয়। নিজেদের জমির মধ্যেই ঠাকুর দালান আছে। সেখানে প্যাণ্ডেল করে পূজা হয়।

প্রচুর উৎসাহ আর উদ্দীপনা নিয়ে আমি বিয়ের পর প্রথমবার দুর্গাপূজা উপলক্ষে শ্বশুড়বাড়ী যাই ২০০৫ সালে। পঞ্চমীর দিন দুপুরে বাড়ী পৌঁছে প্রথমেই মণ্ডপে ঢুকলাম। দেখি আমার দেওর এবং ভাশুরপোরা সদলবলে মণ্ডপ সাজাতে ব্যস্ত। ঢাকিরাও চলে এসেছে। সবার মধ্যেই যেন শেষ মুহূর্তের ব্যস্ততা। পরেরদিন ষষ্ঠি। দেবীর বোধন। চক্ষুদানের মাধ্যমে মাটির প্রতিমায় প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এটাই দুর্গাপূজার শুরু।

সপ্তমীর দিন ভোরবেলা ঢাকের আওয়াজে ঘুম ভাঙ্গল। স্নান করে নতুন শাড়ী পরে খুড়শ্বশুড়মশাইয়ের বাড়ির বারান্দায় হাজির হলাম। দেখি অন্যান্য শাশুড়ী ও জায়েরা ইতিমধ্যেই উপস্থিত। সবাই মিলে ফল কাটা আর পূজার অন্যান্য আয়োজন সাজাতে ব্যস্ত। আমার অনভিজ্ঞতার কথা শ্বশুড়বাড়ীর সবাই জানতেন। কিন্তু ওদের উৎসাহে উৎসাহিত হয়ে আমি কাজে যোগ দিলাম। কিছুক্ষণ পর পূজা শুরু হল। সবাই তখন মণ্ডপে হাজির। প্রয়োজনে পুরোহিত মশাইকে জিনিষপত্র এগিয়ে দিচ্ছি, আবার নিজেদের মধ্যে হাল্কা হাসিঠাট্টাও চলছে। তার মধ্যেই যে যার ঘরের কাজ মেটাতে ছুটছে। পূজার শেষে আবার যার যার নিজের নিজের ঘরে ফিরে গিয়ে খাওয়া-দাওয়া করে কিছুক্ষণের বিশ্রাম। বিকাল থেকে আবার পরেরদিনের পূজার প্রস্তুতি। আর তার ফাঁকেই আশেপাশের বারোয়ারি ঠাকুর দেখতে যাওয়া।

দুর্গাপূজার সব থেকে বড় আর্কষণ অষ্টমী। ভোরবেলা থেকেই তার প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। সেদিন বাড়ীর সবাই উপোস করেন অঞ্জলী দেওয়ার জন্য। অঞ্জলীর পর পূরোহিত মশাই ধূনুচি নাচ সহযোগে দেবীর আরতি করেন। এইদিন সন্ধ্যার আকর্ষণ সন্ধিপূজা। আমাদের বাড়ীতে সন্ধিপূজার একটা বৈশিষ্ট্য আছে। মণ্ডপের ভেতর ঠাকুরের সামনে চারটে কলাগাছকে চারপাশে রেখে বাঁশ দিয়ে একটা কাঠামো তৈরী করা হয়। সেই বাঁশের উপর ১০৮ টা প্রদীপ সাজিয়ে জ্বালানো হয়। সারাদিনের কাজের পর সেদিন আর কারোর বাইরে যেতে ইচ্ছা করে না। মন্ডপেই আসর বসে। ছেলেরা ধূনুচি নাচ আর আরতি করে। তার ফাঁকে ফাঁকে আড্ডা চলে। মেয়েরা বসে মনের সুখে গল্প করে। তখন শাশুড়ী-ননদ-বৌ-ঠাকুর্মা/দিদিমা-নাতি/নাতনীরা সবাই মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়।

পরের দিন নবমী। এইদিনের পূজার বৈশিষ্ট্য হল যজ্ঞ। যজ্ঞের শেষে ঠাকুরকে বিশেষ ভোগ দেওয়া হয়। খিচুরী, নানারকম ভাজা, তরকারী, মাছ ইত্যাদি। তারপর আমরা সবাই একসঙ্গে ঠাকুরের ভোগ খেতে বসি। বাড়ীর ছাদে প্যাণ্ডেল করে ব্যবস্থা করা হয়। আত্মীয় এবং প্রতিবেশীদেরও নিমন্ত্রণ করা হয়। নবমীর সন্ধ্যা থেকেই মন খারাপের শুরু, যেন পূজা শেষের ঘণ্টাধ্বনি শুনতে পাই।

দশমীর দিন সকালে ঢাকের আওয়াজও করুণ লাগে। সবকিছুতেই যেন একটা বিদায়ের সুর। সকালবেলাই দর্পণ বিসর্জন হয়ে যায়। মানে দুর্গাপূজার শেষ। দুপুরবেলা বাড়ীর ছেলেরা সিদ্ধি তৈরী করে। বিকালবেলা প্রতিমা বিসর্জনের আগে বাড়ীর বৌয়েরা যায় দেবীবরণ করতে। ৫ জন এয়ো-স্ত্রী প্রথমে পুরো মণ্ডপটা ৭ বার প্রদক্ষিন করেন। প্রথম মহিলার হাতে থাকে গঙ্গাজলপূর্ণ ঘট। দ্বিতীয়জনের হাতে থাকে শাঁখ। বাকী ৩ জনের হাতে থাকে ধান, দুর্বা, সিঁদূর, ফল, মিষ্টি ইত্যাদি দিয়ে সাজানো থালা। এরপর মহিলারা একইভাবে দেবীকে ৭ বার প্রদক্ষিণ করেন এবং বরণ করেন। এই অনুষ্ঠানটাই আমার বরণডালা নেওয়ার ভার পড়েছিল। বরণপর্ব শেষ হলে শুরু হয় সিঁদূরখেলা। ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে সবাই সিঁদূরে মাখামাখি। প্রথমবার বলে আমার অবস্থা বেশ করুণ হয়েছিল। যাই হোক, বাড়ীর গুরুজনদের তাড়ায় যে যার মত পরিষ্কার হতে দৌড়লাম। ততক্ষণে ঠাকুর গাড়ীতে তোলা হয়ে গেছে। এরপর সবাই মিলে হেঁটে হেঁটে গাড়ীর পিছনে পিছনে গঙ্গার ঘাটে পৌছে গেলাম। বাড়ীর অল্পবয়সী ছেলেরা প্রতিমা নিয়ে গঙ্গায় নেমে গেল। আমরা পারে দাঁড়িয়ে দেবীপ্রতিমাকে গঙ্গায় তলিয়ে যেতে দেখলাম। দেখতে দেখতে মনে মনে বললাম আগামী বছর যেন আবার আসতে পারি। ফেরার পথে অবধারিত খাওয়া দাওয়া। ফুচকা, আলুকাবলি, এগরোল - যার যা মন চাইবে। নতুন বর হিসাবে সেবারের খাওয়ানোর দায়িত্বটা আমার বরের ওপর পড়েছিল। বাড়ী ফিরে সিদ্ধিপান। আমি খুব ভয়ে ভয়ে অল্প একটু খেয়েছিলাম। তারপর শুরু হল বিজয়ার প্রণাম।

পূজার দিনগুলোর অভিজ্ঞতা আমার কাছে অতুলনীয়। বিশেষ করে দুটো জিনিষ আমি অনুভব করেছি। প্রথমত, পূজার আচার বিধিগুলো পুরোপুরি আমাদের সামাজিক সংস্কার থেকে উঠে এসেছে। যেন সত্যিই আমাদেরই কোন ঘরের মেয়ে সপরিবারে বাপের বাড়ী বেরাতে এসেছে। তাই পুরো অনুষ্ঠানের মধ্যেই একটা আন্তরিকতার ছাপ দেখা যায়। আবার তার জন্যই হয়ত আচারবিধির মধ্যে আমাদের মনের "দাও দাও" ভাবটাও প্রবল। অনেক সময় মনে হয় যেন নিজেদের চাহিদাগুলো মেটানোই দেবী বন্দনার মূল কারণ। দ্বিতীয়ত, এ যেন এক মিলনমেলা। সবাই মিলে কাজ করে চলেছি, কিন্তু কারোর মনে কোন ক্ষোভ নেই, দেহে কোন ক্লান্তি নেই। মনে হয় আজকের ব্যস্ত আর বিচ্ছিন্ন জীবনের ফাঁকে এই আনন্দটা যেন আরো বেশী প্রয়োজনীয়।


শীলন সেনগুপ্ত চৌধুরী
৩১শে জুলাই, ২০০৮
কোলকাতা, ইন্ডিয়া

1 comment:

শারদীয়া পুস্পাঞ্জলি said...

Bhishon shundor bornona diyechho Sheelan. Ami konodino barir pujo shebhabe shamna shamni agagora dekhini. Tomar lekha pore anek kichhu jante parlam.

Shraddha.